2.5 অণুবীক্ষণ যন্ত্র

নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - জীববিজ্ঞান (পুরানো সংস্করণ) - জীবন পাঠ | NCTB BOOK

যোদ্ধার কাছে যেমন অস্ত্র, জ্যোতির্বিজ্ঞানীর কাছে যেমন দূরবীক্ষণ যন্ত্র, ঠিক তেমনি জীববিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের কাছে অণুবীক্ষণ যন্ত্র একটি অপরিহার্য গবেষণা সহায়ক উপকরণ। এর সাহায্যে অতি ক্ষুদ্র কোনো বস্তুকে বহুগুণ বড় করে দেখা যায়। তোমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যে যৌগিক অণুবীক্ষণ যন্ত্ৰ রয়েছে, তাতে আলোর সাহায্যে এসব ক্ষুদ্র বস্তু দেখার ব্যবস্থা আছে। এসব অণুবীক্ষণ যন্ত্রকে আলোক অণুবীক্ষণ যন্ত্র বলে। আলোর বদলে ইলেকট্রন ব্যবহার করা হয় যে অণুবীক্ষণ যন্ত্রে, তাকে ইলেকট্রন (ইলেকট্রনিক নয়) অণুবীক্ষণ যন্ত্র বলে। আলোক অণুবীক্ষণ যন্ত্র দুধরনের, সরল অণুবীক্ষণ যন্ত্র এবং যৌগিক অণুবীক্ষণ যন্ত্ৰ।

 2.5.1 সরল অণুবীক্ষণ যন্ত্র (Simple microscope)

 এই অণুবীক্ষণ যন্ত্রে ফুটের উপরে একটি স্তম্ভ থাকে, যার সাথে একটি কাচের স্টেজ সংযুক্ত থাকে। এই কাচের স্টেজে দুটো ক্লিপ লাগানো থাকে। স্তম্ভের নিচের দিকে সম্মুখভাগে একটি আয়না রয়েছে। স্তম্ভের উপরে একটি টানা নল এবং এর বাহুতে লেন্স ধরে রাখার জন্য আংটা থাকে।

 এই আংটায়লেন্স বসিয়ে স্কুল এডজাস্টমেন্ট ক্ষু ঘুরিয়ে দ্রষ্টব্য বস্তুর উপর ফোকাস করা যায়। আয়না দিয়ে দ্রষ্টব্য বস্তুতে আলো প্রতিফলিত করে পরীক্ষার কাজ শুরু করতে হবে। যে ভিত্তির উপর যন্ত্রটি দাঁড়িয়ে, সেটিকে পাদদেশ বলে ।

2.5.2 যৌগিক অণুবীক্ষণ যন্ত্ৰ (Compound Microscope):

যৌগিক অণুবীক্ষণ যন্ত্র কীভাবে ব্যবহার করতে হয় তা জানার পূর্বে এর বিভিন্ন অংশগুলোর নাম জেনে নেওয়া প্রয়োজন। অণুবীক্ষণ যন্ত্রের চিত্রটি লক্ষ কর।

স্টান্ড: এটি বেজ এর উপর দণ্ডায়মান একটি উল্লম্ব পিলার।

আর্ম: স্ট্যান্ড এর উপরের দিকে বাঁকানো অংশকে আর্ম বলে।

বেজ: স্ট্যান্ড এর নিচের দিকে পাটাতনের মতো অংশটির নাম বেজ ।

স্টেজ: আর্ম এর নিচের অংশে স্টেজ লাগানো থাকে।

বান্ডি টিউব: অণুবীক্ষণ যন্ত্রের উপরের দিককার একটি নলাকার অংশ যার একপ্রান্তে আইপিস এবং অপর প্রাচ্ছে অবজেকটিভ লেন্সগুলো লাগানো থাকে।

 নোজপিস ও অবজেকটিভ: বড়ি টিউবের নিচের দিকের ঘূর্ণনশীল অংশটিকে নোজপিস বলে। এতে তিনটি অবজেকটিভ (লেন্স) লাগানো থাকে, যথা- লো পাওয়ার অবজেকটিভ (10x-12x), হাই পাওয়ার অবজেকটিভ (40x-45x), অয়েল ইমারশন অবজেকটিভ (100x )। কোনো কোনো যন্ত্রে অবশ্য আরও একটি অবজেকটিভ থাকে, যাকে বলে স্ক্রিনিং অবজেকটিভ (4x-5x)। এখানে x এর সাথে উল্লিখিত সংখ্যাগুলো নির্দেশ করছে যে উক্ত লেগ বা লেন সমবায় দ্বারা কতগুণ বিবর্ধন ঘটে।

আইপিস: বড়ি টিউবের উপরের অংশে একটি (monocular) বা দুটি (binocular) আইপিস (লেন্স) লাগানো থাকে। এর বিবর্ধন ক্ষমতা সাধারণত 10x-12x হয়।

ফাইন অ্যাডজাস্টমেন্ট নৰ: এটি একটি ছোট নব। এটিকে ঘুরিয়ে স্টেজকে ওঠা-নামা করানোর মাধ্যমে স্লাইডকে লেন্সের ফোকাস দূরত্বের (focal length) ভিতরে বা বাইরে নেওয়া যায়। এটিকে অনেকখানি ঘোরালে স্টেজের অল্প একটু সরণ ঘটে অর্থাৎ এটি দিয়ে ফোকাসের সূক্ষ্ম সমন্বয় করা হয়।

কোর্স অ্যাডজাস্টমেন্ট নব: এটি একটি বড় নব। এটিকে ঘুরিয়ে স্টেজকে ওঠা-নামা করানোর মাধ্যমে স্লাইডকে লেন্সের ফোকাস দূরত্বের ভিতরে বা বাইরে নেওয়া যায়। এটিকে অল্প ঘোরালেই স্টেজের অনেকখানি সরণ ঘটে অর্থাৎ এটি দিয়ে ফোকাসের স্থূল সমন্বয় করা হয়।

সাবস্টেজ ডায়াফ্রাম ও কনডেন্সার: স্টেজের নিচে সাবস্টেজ অবস্থিত যেটা উঠা-নামা করানো যায় এবং এর সাথে একটি কনডেন্সার লাগানো থাকে। কনডেন্সারের মধ্যে একটি ডায়াফ্রাম বা পর্দা থাকে যেটা কতটুকু আলো কনডেন্সারের ভিতরে প্রবেশ করবে তা নির্ধারণ করে।

আলোর উৎস: বেস-এর কেন্দ্রে একটি আলোর উৎস থাকে, যেখান থেকে আলো কনডেন্সারের মধ্য দিয়ে লেন্সে প্রবেশ করে।

যৌগিক অণুবীক্ষণ যন্ত্রের ব্যবহার,

অণুবীক্ষণ যন্ত্রে প্রাকৃতিক আলো ব্যবহার করতে চাইলে গবেষণাগারের আলোকিত স্থানে এটি স্থাপন করতে হবে। প্রথমেই আয়নাটি এমনভাবে স্থাপন করতে হবে যাতে প্রতিফলিত আলোকরশ্মি মঞ্চটির ছিদ্র বরাবর বসানো কাচের স্লাইডের নিচে প্রতিফলিত হয়। আর যদি কৃত্রিম আলোক উৎস অণুবীক্ষণ যন্ত্রের অংশ হিসেবে উপস্থিত থাকে, তাহলে শুধু সেটি জ্বালালেই চলবে। যে স্লাইডটি পর্যবেক্ষণ করা হবে তা মঞ্চের ক্লিপের সাহায্যে এঁটে দিতে হবে। এরপর নোজপিস ঘুরিয়ে নিয়ে অবজেকটিভের কম পাওয়ারের লেন্স স্লাইড বরাবর স্থাপন করতে হবে। এবার প্রথমে কোর্স অ্যাডজাস্টমেন্ট স্ক্রু এবং পরে ফাইন অ্যাডজাস্টমেন্ট স্ক্রু ঘুরিয়ে দেখার বস্তুটি ফোকাসে আনতে হবে। এবার বড়ি টিউবে স্থাপিত আইপিস লেন্সে চোখ রেখে দেখতে হবে। প্রয়োজনে ফাইন অ্যাডজাস্টমেন্ট স্ক্রু ঘুরিয়ে নেওয়া যাবে। মনোকুলার হোক বা বাইনোকুলার, অণুবীক্ষণ যন্ত্রে দেখার সময় দুটি চোখই খোলা রাখার চেষ্টা করতে হবে। প্রথমে কষ্ট হলেও ধীরে ধীরে অভ্যাস হয়ে যাবে। এক চোখে অণুবীক্ষণ যন্ত্র দেখলে চোখ সহজেই ক্লান্ত হয়ে পড়ে। যদি উচ্চ পাওয়ারের দরকার হয়, তবে অবশ্যই শিক্ষকের সহায়তা নিয়ে নোজপিস ঘুরিয়ে উচ্চ পাওয়ারের লেন্স স্থাপন করতে হবে।

স্টেইনিং (staining),

কোষ বা টিস্যুর পাতলা স্তরকে যখন অণুবীক্ষণ যন্ত্রে দেখা হয়, তখন সেটি যে জলীয় মাধ্যমে অবস্থান করে, তার থেকে আলাদা করে চিহ্নিত করা মুশকিল। এ সমস্যা সমাধান করার বিভিন্ন উপায় রয়েছে, তার মধ্যে একটি উপায় হলো ওই কোষ বা টিস্যুকে রং করা, যাতে সেই রং দেখে পারিপার্শ্বিকতার সাপেক্ষে তার অবস্থান এবং আকৃতি আলাদা করে চিহ্নিত করা যায়। অনেক সময় এই রঞ্জন প্রক্রিয়া এত সূক্ষ্মতার সাথে করা সম্ভব, যাতে করে শুধু বিশেষ ধরনের কোষ কিংবা কোষের বিশেষ কোনো অংশ বা অঙ্গাণু অথবা টিস্যুর নির্দিষ্ট কোনো উপাদানই কেবল রঙিন হয়। একেই বলে স্লাইড স্টেইনিং। যেসব রঞ্জক পদার্থ দিয়ে স্টেইনিং করা হয়, সেগুলোকে একত্রে স্টেইন (stain) বলে। 

2.5.3 ইলেক্ট্রন অণুবীক্ষণ যন্ত্র (Electron microscope),

বিবর্ধনের জন্য ব্যবহৃত তরঙ্গের তরঙ্গ দৈর্ঘ্য যত কম হবে, তত ছোট বস্তুকে বিবর্ধিত করা সম্ভব হবে। সাধারণত বিবর্ধনে ব্যবহৃত তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের প্রায় অর্ধেকের চেয়ে ছোট বস্তু অণুবীক্ষণ যন্ত্রে দেখার মতো করে ফোকাস করা সম্ভব নয়। দৃশ্যমান আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য 400-700 ন্যানোমিটারের মধ্যে থাকে। ভাই সবচেয়ে উন্নতমানের আলোক অণুবীক্ষণেও 200 ন্যানোমিটারের থেকে ছোট বস্তুকে বিবর্ধিত করে দেখা যায় না, এমনকি অনেক শক্তিশালী বহুসংখ্যক লেন্সের সমন্বয় করেও সেটি করা যায় না। ফলে আলোক অণুবীক্ষণে কোষের কোষঝিল্লি, নিউক্লিয়াস এবং সাইটোপ্লাজম ছাড়া আর কিছু খুব একটা ভালো করে বোঝা যায় না। সাইটোপ্লাজমে অবস্থিত অঙ্গাণুগুলোকে আলাদা করে দেখা যায় না। এ সমস্যা সমাধানের জন্য দৃশ্যমান আলোর পরিবর্তে ইলেক্ট্রন তরঙ্গ ব্যবহৃত হয়, কেননা ইলেক্ট্রনের তরঙ্গ দৈর্ঘ্য দৃশ্যমান আলোর চেয়ে অনেক ছোট করা সম্ভব। কাচের লেন্সের পরিবর্তে সেখানে ব্যবহৃত হয় শক্তিশালী তড়িৎ চুম্বক, যা ইলেক্ট্রন স্রোতের গতিপথ বাঁকিয়ে দিতে পারে, ঠিক যেরকম কাচ, আলোকে বাঁকিয়ে দেয়। ফলে কোষের ভিতরকার অঙ্গাণুগুলো স্পষ্ট দেখা সম্ভব হয়। যে অণুবীক্ষণ যন্ত্রে ইলেক্ট্রন তরঙ্গকে ব্যবহার করে বিবর্ধন করা হয়, তাকে ইলেক্ট্রন (ইলেক্ট্রনিক নয়) মাইক্রোস্কোপ (electron microscope) বা ইলেক্ট্রন অণুবীক্ষণ য বলে। উল্লেখ্য, ইলেক্ট্রন তরঙ্গ দিয়ে তৈরি করা ছবি আমরা সরাসরি চোখে দেখতে পাই না। ইলেইন অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাথে সংযুক্ত একটি কম্পিউটার ঐ অদৃশ্য ছবিকে আমাদের দেখার উপযোগী ছবিতে পরিণত করে যা, কম্পিউটারের মনিটরে দৃশ্যমান হয়।

একক কাজ

কাজ : অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে উদ্ভিদকোষ (পেঁয়াজ কোষ) পর্যবেক্ষণ কর।

প্রয়োজনীয় উপাদান: পেঁয়াজ, ব্লেড, স্পাইফ, কভার স্লিপ, ওয়াচ গ্লাস, তুলি, গ্লিসারিন, স্যাক্রানিন প্রবণ, ড্রপার, ব্লটিং পেপার এবং অণুবীক্ষণ যন্ত্র।

পদ্ধতি: পেঁয়াজ থেকে শুকনো খোসাগুলো ছাড়িয়ে নাও। এবার যেকোনো একটি স্ফীত, রসাল শল্কপত্র নাও। ব্লেড দিয়ে শল্কপত্রের উপরিভাগ থেকে সামান্য ত্বকস্তর তুলে নিয়ে ওয়াচ গ্লাসের পানিতে রাখ । আরেকটি ওয়াচ গ্লাসে স্যাফ্রামিন দ্রবণ নাও। এবারে ভুলির সাহয্যে প্রথম ওয়াচ গ্লাসের পানি থেকে ত্বকতর তুলে নিয়ে দ্বিতীয় ওয়াচ গ্লাসের স্যাফ্রানিন দ্রবণে রাখ এবং ৩০ সেকেন্ড অপেক্ষা কর। তারপর তুলি দিয়ে স্যাফ্রানিনরক্ষিত ওয়াচ গ্লাস থেকে ত্বন্তরটি আবার প্রথম ওয়াচ গ্লাসের পানিতে রাখ। উল্লেখ্য স্যাফ্রানিন এখানে স্টেইন হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। একটি পরিষ্কার শুল্ক স্লাইডের উপর ২-৩ ফোঁটা গ্লিসারিন দিয়ে তার উপর ধীরে ধীরে কভার স্লিপ রাখ যেন বাতাস বা বুদবুদ না ঢোকে। কভার স্লিপের বাইরে থাকা অতিরিক্ত দ্রবণ গ্লিসারিন ব্লটিং পেপার দিয়ে সাবধানে তৰে নাও। পর্যবেক্ষণ: যৌগিক অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিম্নক্ষমতাসম্পন্ন অভিলক্ষ (Objective) দিয়ে দেখ। আয়তাকার, পাতলা কোষপ্রাচীরযুক্ত কোষ দেখতে পাবে। এবার উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন অভিলক্ষ দিয়ে দেখ। প্রতিটি কোষে পাতলা দানাযুক্ত প্রোটোপ্লাজম, কোষগহ্বর এবং একপাশে একটি নিউক্লিয়াস দেখতে পাবে। এবার যা যা দেখলে তার চিত্র পাতায় এঁকে চিহ্নিত কর।

 

একক কাজ
কাজ : অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে প্রাণিকোষ (অ্যামিবা) পর্যবেক্ষণ কর । প্রয়োজনীয় উপাদান: অণুবীক্ষণ যন্ত্র, স্লাইড, কভার স্লিপ, ড্রপার, পেট্রিডিস, পিগেট, কাচের দণ্ড, কাচের বাটি এবং পুকুরের তলদেশ থেকে সংগৃহীত ডালপালাসহ পচা পাতা ও পানি। পদ্ধতি : কাজের শুরুতে কোনো পচা ডোবা বা পুকুরের তলদেশ থেকে ডালপালাসহ পচা পাতা সংগ্ৰহ কর। এগুলো ছোট ছোট করে কেটে কাচের বাটিতে রেখে অল্প পানিসহ কাচের দণ্ড দিয়ে আস্তে আস্তে নাড়তে থাক। এভাবে কিছুক্ষণ নেড়ে বাটিটিকে একস্থানে স্থিরভাবে রেখে দাও। কাচ পাত্রে তলানি জমলে একটি পিপেট দিয়ে ঐ তলানি তুলে পেট্রিডিসে জমা কর। এবার ড্রপার দিয়ে এক ফোঁটা তলানি কাচের স্লাইডে তুলে কভার স্লিপ দিয়ে চাপা দেওয়ার পর অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে বসাও। পর্যবেক্ষণ : স্লাইড একটু এদিক সেদিক করে খোঁজাখুঁজি করলেই স্বচ্ছ জেলির মতো কতগুলো ক্ষুদ্র জীব দেখতে পারে। এগুলোই অ্যামিবা। এতে বহু ক্ষণপদ এবং গহ্বর দেখতে পাবে এবং কোষটিকে বেষ্টন করে প্লাজমালেমা নামক একটি পর্দা দেখতে পাবে। এতে উদ্ভিদকোষের মতো কোনো প্লাস্টি থাকে না। উদ্ভিদকোষ ও প্রাণিকোষের মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখা গেল কি? এবার যা যা দেখলে তার চিত্র খাতায় এঁকে চিহ্নিত কর।
Content added By
Content updated By
Promotion